Select Page

দেশী তেল পেশাই যন্ত্রকে তেলের ঘানি, ঘানিযন্ত্র, ঘানিকল বা ঘানিগাছ বলা হয়। অর্থাৎ যে যন্ত্রে সরিষা, সূর্যমুখীর বীজ, বাদাম, নারিকেল বা অন্যান্য কোনো তেল বীজকে নিষ্পেষণ করে তেল ও খইল আলাদা করা হয়। এইটি একটি প্রাচীন জীবিকা।

ঘানিতে যে তেল তৈরী করা হয় তাকে বলে কোল্ড প্রেস। আরও পড়ুন …..

ঘানি কাজ করে ঘূর্ণন দ্বারা। সাধারণতঃ ঘানি টানবার জন্য গরু ব্যবহার করে। তাই থেকে “কলুর বলদ” বাগধারাটি এসেছে। অর্থাৎ সারাদিন একটানা ঘানি টানা যার কাজ। ঘানি টানা খুব পরিশ্রমের কাজ। তাই আগেকার দিনে সশ্রম কারাদন্ডের বন্দীদের দিয়ে ঘানি ঘোরানো হত। তাই থেকে জেলে যাওয়াকেই অনেক সময় জেলের ঘানি ঘোরানো বলা হয়।

আজকাল আর সেভাবে ঘানি চোখে পরে না। মেশিনের তেলের দাম কম হওয়ায় প্রতিযোগিতায় ঠিকতে না পেরে অনেকেই পেশা পরিবর্তন করেছেন। তাছাড়া গরুটাকে সারাদিন এভাবে কষ্ট দেয়াটাও অনেকে সমর্থন করেন না। তাই যুগে যুগে মানুষ কত বুদ্ধিই না বের করেছেন এই ঘানি ঘুরাতে।

ঘানির ইতিহাস ও বর্তমান

প্রত্নতাত্ত্বীক ঘানি

প্রত্নতাত্ত্বীক নিদর্শনেও ঘানি।

ভারতীয় উপমহাদেশে কলুরা তেল নিষ্কাশনের নানা কৌশল ও যন্ত্র ব্যবহার করে থাকে। উড়িষ্যা প্রদেশের উত্তরাংশে সঢ়ইকলা নামক একটি স্থানে তিন রকমের তেল নিষ্কাশনের ঘানি আছে, যেমন:

  • দুই বলদে টানা নালিবিহীন কাঠের তৈরি ঘানি,
  • এক বলদে টানা নালিযুক্ত কাঠের তৈরি ঘানি,
  • এক বলদে টানা নালিযুক্ত দুখন্ড কাঠ দ্বারা তৈরি পিঁড়িবিশিষ্ট ঘানি।

দুই বলদে টানা নালিবিহীন কাঠের তৈরি ঘানি:

প্রথম ধরনের ঘানি শক্ত একখন্ড কাঠ দ্বারা তৈরি। এটি মাটির নিচে ৪/৫ হাত পর্যন্ত পোঁতা হয়, ভূমির উপরে থাকে প্রায় হাত দেড়েক। এ ঘানিগাছের মাথায় খোল থাকে। তেলি তার সুবিধামতো এটি প্রস্তুত করে নেয়। অনেকদিন ব্যবহার করলে এর উপরের অংশ ক্ষয়ে যায়, তখন কিছুটা কেটে আবার ব্যবহারের উপযোগী করে নেওয়া হয়। মূল যন্ত্রের নাম হচ্ছে ঘনা। যে দন্ড দ্বারা তেলবীজ পেষা হয় তার নাম লাঠি। বলদ দুটি যে পাটায় জোতা থাকে তাকে পাঁজরি বলে। এর সঙ্গে বাঁশপাতি নামে অন্য একখন্ড কাঠ জোড়া থাকে যার বাঁকা মুখের নাম হলো মগরমুহি। পাঁজরিতে জোয়াল বাঁধা হয়। পাঁজরির উপরে খাড়া মালকুম দন্ডে থাকে দুতিনটি ছিদ্র। আর একখানা বাঁকা কাঠ মালকুমের উপরিভাগে থাকে, তার মধ্যেকার খোপে লাঠির উপরাংশ যথাযথভাবে যুক্ত হয়ে যায়। এ ছাড়া তেল পেষার কাজের সুবিধার জন্য থাকে একটি শাবল, যার মুখখানা ঈষৎ বাঁকানো। খৈল তোলা ও অন্যান্য কাজে তা ব্যবহূত হয়। আর একটা ন্যাকড়া-বাঁধা কাঠের কাঠি থাকে। এর সাহায্যে ঘানির ভেতর থেকে তেল শুষে বের করে নিতে সুবিধা হয়।

এরা কখনও এক বলদ জোতে না, বলদের চোখে ঠুলি বাঁধে না এবং ঘানি ছিদ্রও করে না।

এক বলদে টানা নালিযুক্ত কাঠের তৈরি ঘানি:

এক বলদে টানা ঘানিগাছ মাটির নিচে থাকে দু হাত ও উপরে থাকে দেড় হাত মাত্র। এরও খোল থাকে, ওই খোলের নিচের দিকে একটি গর্ত থাকে যা দিয়ে নালিপথে তেল চুঁইয়ে বের হয়। এ ঘানির নাম ঘানা। যে নালিপথ দিয়ে তেল বের হয় তার নাম নেরিও। নিচের যে পাত্রে তেল জমা হয় তার নাম গাড়ু অর্থাৎ পাত্র। পেষণ দন্ডের নাম লাটিম। মাটি থেকে উপরের দিকে যে কাঠের পাটা থাকে তাকে বলে কাতের। বাঁকা কাঠের নাম ঢেঁকা। এতে সাধারণত দুতিনটি খোপ কাটা থাকে, এর মধ্যে লাটিমের উপরের অংশ ঢুকানো হয়। লাটিমের সঙ্গে আলগাভাবে যুক্ত থাকে জোয়াল। তার সঙ্গে আড়াআড়িভাবে একটি কাঠি কাতেরের শেষাংশের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকে। এ কাঠির নাম গলি। ঘানি চালক কাতেরে পা ঝুলিয়ে বসে থাকে, আরও ভার লাগলে পাথর বা কাঠখন্ড অর্থাৎ ভারি কিছু চাপিয়ে রাখা হয়।

এক বলদ ও দুই বলদে টানা ঘানির মধ্যে পার্থক্য এই যে,

  • দুই বলদে টানা ঘানির লাঠি লম্বা, এক বলদে টানাওয়ালাদের লাঠি খাটো বা ছোট এবং তা ঘরের মধ্যে বসানো যায়।
  • দুই বলদওয়ালা কলুরা ঘানি স্থাপন করে ঘরের বাইরে। এরা গরুর চোখে ঠুলি বাঁধে না। এক বলদওয়ালা কলুরা গরুর চোখে ঠুলি বাঁধে।
  • দুই বলদে টানা ঘানি মাটির কাছাকাছি থাকে, এক বলদওয়ালার ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়, কেননা তাতে গাড়ু বা তেলপাত্র ভেঙ্গে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

এক বলদে টানা নালিযুক্ত দুখন্ড কাঠ দ্বারা তৈরি পিঁড়ি বিশিষ্ট ঘানি:

এই ধরনের ঘানিটি টানা হয় বলদ দিয়ে। এর নামও ঘানা। এর উপরের অংশে কাঠের তৈরি জামবাটির মতো একটা বড় অংশ থাকে, তার নাম হলো পিঁড়ি। পেষণ দন্ডের নাম জাঠ। এর উপরের অংশে একটা বাঁকা কাঠখন্ড আটকানো থাকে, তার নাম মাকড়ি। এ মাকড়ির পিছনে ছিদ্র থাকে, তার ভিতর দিয়ে দড়ি গলিয়ে মত্থম (মতথম) খুটার সঙ্গে আটকানো থাকে। এ মতথম খুঁটা পাটার উপর খাড়াভাবে রাখা হয়। পাটার যে প্রান্ত ঘানার গায়ে ঘষে যায় সেখানে গোলোই নামে একটি কাঠের টুকরা জোড়া লাগানো থাকে। ঘানার যে স্থান দিয়ে তেল বের হয় তার নাম পাতনালি। এর নিচের পাত্রে তেল জমে। ঘানির মধ্যে বীজ নেড়েচেড়ে দেওয়ার জন্য সাঁকনি নামক একটি ঘূর্ণন কাঠি থাকে। গরু জুতবার জন্য থাকে জোয়াল। গরুর চোখে চামড়ার ঠুলি থাকে। জোয়াল পাটার সঙ্গে আড়াআড়িভাবে একটা বাঁকা কাঠি দ্বারা যুক্ত, তার নাম কাইনুড়ি। এসব ঘানির কাঠ শক্ত ও মজবুত হতে হয় এবং এ উদ্দেশ্যে সাধারণত শালকাঠ ব্যবহূত হয়।

ভারতীয় উপমহাদেশের নানা জায়গায়, বর্তমানে বাংলাদেশেও এক বলদ ও দু বলদে টানা ঘানির কথা জানা যায়। তবে দক্ষিণ বঙ্গে সাধারণত এক বলদে টানা ঘানি দেখা যায়। দু বলদের ছিদ্রহীন ঘানি উড়িষ্যা ও অন্ধ্র প্রদেশে চালু আছে। পশ্চিমবঙ্গ এলাকার মেদিনীপুর এবং হুগলিতেও এর প্রচলন আছে। গুজরাটের ঘানিও এ প্রকারের।

বাংলাদেশে যেসব ঘানি এখনও রয়েছে তা গরুতে অথবা ঘোড়ায় টানে। এসব ঘানিগাছ শক্ত কাঠ দ্বারা তৈরি হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় অর্থাৎ যে স্থানে যে ধরনের শক্তকাঠ পাওয়া যায় তা দিয়ে ঘানিগাছ তৈরি করা হয়। দেশের দক্ষিণ অঞ্চলে যেসব ঘানিগাছ আছে তা সাধারণত তেঁতুল, চটকা, কড়ুই গাছের কাঠ দ্বারা নির্মিত। এ কাঠ শক্ত এবং মাটিতে সহসা নষ্ট হয় না। ঘানিগাছের অভ্যন্তরে দেশিয় বাবলা কাঠও ব্যবহূত হয়। দেশি ঘানিগাছ প্রায় ৬ হাত বা তার বেশি লম্বা হয়। এর প্রায় অর্ধাংশ মাটির নিচে পুঁতে রাখা হয় যাতে নড়াচড়া না করে।

দেশি ঘানিগাছের উপরের অংশকে ডোঙ্গা বলে। এখানে তেল তৈরির জন্য সরিষা ঢালা হয়। গাছের উপরের বেড় দেওয়া কাঠকে বলে ওড়া। প্রায় এক হাত বাঁকানো জাট ওড়ার সঙ্গে যুক্ত থাকে। ঘানিতে ব্যবহূত অন্যান্য দ্রব্যাদির নাম হচ্ছে জাট, মাকড়ি, ওড়া, নলি, এলেবাড়ি, লোহার বাটুল, কাতাড়ি (তক্তা) ইত্যাদি।

ঘানিগাছের মাঝামাঝি একটি কাতাড়ি থাকে যার উপর বসা যায়। চালক এর উপর বসে অথবা ওজন বাড়ানোর জন্য তার উপর পাথর বা ভারি দ্রব্য চাপা দিয়ে রাখে। ঘানিগাছের নিচের অংশে নলি দিয়ে তেল বের হয়, এর নিচে থাকে তৈলপাত্র, এ পাত্রেই তেল জমা হয়। প্রথমে অতি সামান্য পানি মিশিয়ে সরিষাকে ঘানিগাছের মাথার খোলে ঢেলে দেওয়া হয়। গরু বা ঘোড়া চলতে থাকলে জাট ঘুরতে থাকে এবং চাপের ফলে সরিষা বা অন্যান্য তৈলদ্রব্য গুঁড়া হয়ে যায় এবং পরিশেষে তেল বের হয়।

ময়মনসিংহে এবং দেশের অন্যান্য স্থানে এক শ্রেণির কলু আছে যারা গরুর বদলে নিজেরাই ঘানি টানে। কলুরা সবরকম তেল প্রস্তুত করে ও খইল বিক্রয় করে। তিলের খইল সার হিসেবে ব্যবহূত হয়।

বাংলাদেশে ও বাংলাদেশের বাইরে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে তেলের ঘানি টানার দৃশ্যঃ

প্রায় সব ঘানির একটা কমন জিনিস দেখা যাচ্ছে তা হচ্ছে কেমন যেন নোংরা পরিবেশ।

ঘানি নিয়ে বাংলাদেশে একটা সিনেমাও হয়েছে। ইচ্ছে হলে দেখতে পারেন

আপনাদের যদি কোন জিজ্ঞাসা থাকে তবে নির্দিধায় প্রশ্ন করতে পারেন। শুধু একটা মেসেজ পাঠান

তথ্য সূত্রঃ উইকিপিডিয়া, বিভিন্ন ওয়েব সাইট থেকে।


Notice: ob_end_flush(): Failed to send buffer of zlib output compression (1) in /home/joypury/public_html/wp-includes/functions.php on line 5427

Notice: ob_end_flush(): Failed to send buffer of zlib output compression (1) in /home/joypury/public_html/wp-includes/functions.php on line 5427